ঢাকা,শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকন্ঠা

রফিকুল ইসলাম, কক্সবাজার ::৯ জুলাই গতকাল মঙ্গলবার বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ – বিজিবি মহাপরিচালক, পুলিশ মহাপরিদর্শক, র‌্যাব মহাপরিচালক, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ – সিআইডি ও পুলিশের বিশেষ শাখা-এসবি প্রধান সহ বেশ কয়েক জন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির গুলো পরিদর্শনে আসছেন। আশ্রয় দেয়ার সময় থেকে গত ২২ মাসে রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি অনেকটা বদলিয়েছে।এরা ক্রমশঃ হিংস্র হচ্ছে, জড়াচ্ছে স্থানীয়দের সাথে নানা বিরোধে, বিভিন্ন গুরুতর অপরাধেও। প্রতিনিয়ত রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে শত শত রোহিঙ্গা বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে মিয়ানমার যাতায়াত করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ।

গত ২৬ মার্চ বালুখালী শিবিরের ই-ব্লক থেকে পুলিশ আয়েশা বেগম (১৯) নামের এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে। ধর্ষণের পর তাঁকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মুখোশধারী একদল রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং শিবির থেকে খতিজা বেগম নামের এক কিশোরীকে অপহরণের পর ধর্ষণ করে। এরপর হত্যা করে লাশ জঙ্গলে ফেলে যায়। উখিয়ার বালুখালী শিবিরের বাসিন্দা এক গৃহবধূ বলেন, সম্প্রতি এক রাতে মুখোশধারী তিন যুবক ঘরে ঢুকে তাঁর এক কিশোরী মেয়েকে অপহরণের চেষ্টা চালায়।
ক্যাম্পের একাধিক সূত্র জানা যায়, দিনে একরকম থাকলেও রাতেই পাল্টে যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেহারা। অন্ধকারে অরক্ষিত হয়ে পড়ে ক্যাম্পগুলো। কিছু রোহিঙ্গা দুর্বৃত্ত ক্যাম্পে বসেই মাদক,মানব,মুদ্রা পাচার, স্বর্ণ সহ চোরাচালান ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। খবর মতে ক্যাম্প ও রাখাইনে বিদ্যমান একটি সন্ত্রাসী উগ্র গ্রুপ কৌশলে তাদের বিরুদ্ধাচরণকারীদের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব অটুট রাখছে সর্বদা। অবকাঠামোগত সমস্যা, বিদ্যুৎ না থাকা ও অন্ধকার পরিবেশসহ নানা কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সন্ত্রাসী-গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে।ফলে ক্যাম্পের ভেতরে খুন,চাঁদাবাজি,মুদ্রা পাচার, গুম, ইয়াবা, মানব পাচার, স্বর্ণ সহ অন্যান্য পণ্য চোরাচালান, অপহরণসহ নানা অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে। দেশি অস্ত্রের পাশাপাশি ভারী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নজরে এসেছে পুলিশের। ইতোমধ্যে এসব সন্ত্রাসী কার্যকলাপ রোধে ১৬টি প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য লিখিতভাবে সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে।
দিনের আলোয়ে সচ্ছ,অসহায়, নির্যাতিত,নিরীহ আম জনতা মনে হলেও রাত যত ঘনিয়ে আসে ততই অচেনা, অপরিচিত, অনিরাপদ, নিয়ন্ত্রণ হীন ভয়ংকর হয়ে ওঠে রোহিঙ্গারা।
ক্যাম্প গুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের ভেতরে অবৈধভাবে যত্রতত্র বাজার বসানো বন্ধ করে বাজার পরিচালনায় বৈধ নীতিমালা তৈরি, ক্যাম্পের ভেতরে স্বর্ণের দোকান বসানো এবং স্বর্ণ বন্ধকের ব্যবসা বন্ধ, ক্যাম্পে লাইট পোস্ট এবং সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ক্যাম্পের মাঝি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সুন্দর নীতিমালা প্রণয়ন, রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা অবৈধ মোবাইল সিম বন্ধ করে বৈধভাবে সিম ব্যবহারের ব্যবস্থা, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ উত্তোলনের ক্ষেত্রে সদস্যদের স্বশরীরে উপস্থিতি নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের দাবি প্রদানের জন্য বৈধ সংগঠনের নীতিমালা প্রণয়ন, ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি, ক্যাম্পে মাদ্রাসা তৈরির ক্ষেত্রে বৈধ বা অনুমতির ব্যবস্থা গ্রহণ, রাতে ক্যাম্পে শরাণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনের প্রতিনিধির উপস্থিত নিশ্চিত করা, এছাড়াও ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা গ্রহণের মত বেশ কিছু প্রস্তাবনা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।এসব জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ বিলম্বিত হলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিকে পুলিশের  প্রতিবেদন মতে, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে অবস্থান করার পর থেকে জড়িয়ে পড়ছেন নানা অপরাধে। গত ২১ মাসে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, চোরাচালান, ধর্ষণ, ডাকাতি,মাদক ও মানবপাচারসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা। গত ২১ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেসব অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে, তার মধ্যে ৩২৮টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৭১১ জন। এরমধ্যে খুনের ঘটনা রয়েছে ৩১টি, অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে ১৯টি ও মাদক উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে ১১৮টি।
রোহিঙ্গা বিশেষজ্ঞ এবং উখিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে বলেন, দিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও রাতের অন্ধকারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অনেকটা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। সন্ত্রাসীরা অপকর্ম করে পাহাড়ে কিংবা মিয়ানমারে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কারণ দেশী বিদেশী সেবা সংস্থা গুলো রোহিঙ্গাদের ভাষানচর স্হানান্তরে সরকারের উদ্যেগকে বিরোধিতা করছে। তারা আবার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফিরে যেতেও অনুৎসাহিত করছে।এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে হবে বলে তিনি জানান। অন্যদিকে গত কয়েক মাস ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন স্হানীয় লোকজনের সাথে রোহিঙ্গা অহেতুক নানা বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে।রোহিঙ্গাদের অত্যাচারে স্হানীয় লোকজন গবাদি পশু লালন পালন করছে না দুই বছর ধরে। গতকাল সোমবার দুপুরে বালুখালী -৮ নং ক্যাম্প সংলগ্ন অসহায় স্হানীয় দিলদার বেগম(২৮) কে রোহিঙ্গারা মেরে হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত স্হানীয়রা কোথাও ন্যায় বিচার পাচ্ছে না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফেরত পাঠানো বিলম্ব হলে জঙ্গি ও সন্ত্রাস বাদ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন। যেটি শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ না থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ারও হুমকির কথা বলা হচ্ছে। গত শনিবার উখিয়ায় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কে এম আবদুস সালাম রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশী বিদেশী সেবা সংস্থা গুলোকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে না জড়াতে হুঁশিয়ার করেছেন।
তবে রাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অনিয়ন্ত্রিত বা অরক্ষিত বলতে রাজি নন উখিয়া থানার ওসি মোঃ আবুল খায়ের। তিনি জানান, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২৪ ঘণ্টা পুলিশের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। যৌথ বাহিনীর টহল দেওয়া হচ্ছে। স্থাপন করা হয়েছে ৫ টি পুলিশ ক্যাম্পও। ফলে আগের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক নিয়ন্ত্রণে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোর এ পরিস্থিতিতে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম, পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, সিআইডি প্রধান শফিকুল ইসলাম ও পুলিশের বিশেষ শাখা এসবির প্রধান মীর শহিদুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার (৯জুলাই)দুপুরে  কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে করেছেন ।

পাঠকের মতামত: